পলিসি আড্ডা পরিক্রমা ২০১৪ পলিসি আড্ডা ব্লগটি শুরু হয় ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এখানে যাঁদের লেখা, ছবি, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়েছে তাঁরা বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের মানুষ। কেউ সাংবাদিক, কেউ শিক্ষক, কেউ বা ছাত্র, কেউ সমাজকর্মী। ব্লগটির পরিচয়পত্রে যেমনটা আমরা বলেছি, পলিসি-আড্ডা সহজ কথনে, আড্ডার ভঙ্গিতে দেশের নানাবিধ বিষয়ে কথা বলার, মতামত দেওয়ার মঞ্চ। আবার সবসময়ই যে তা নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে হতে হবে ব্যাপারটা তা-ও নয়। আমাদের আগ্রহের অন্য নানা বিষয়েই আমরা এখানে লিখতে পারি। তবে সাইটের নামটিতেই ভাবটি পরিষ্কার হওয়াতে আমাদের লেখকরা রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বা উন্নয়ন সংক্রান্ত নানান ছোট-বড় বিষয় নিয়ে লেখাতেই মনোযোগ দিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ যে তাঁরা পলিসি-আড্ডাকে লেখার জন্য বেছে নিয়েছেন। তাঁদের অবদানেই পলিসি-আড্ডাতে গত বছর ৫৫টি ব্লগপোস্ট ও চারটি ছবি ব্লগ দেওয়া গেছে। আমরা লেখাগুলো নিয়ে পলিসি আড্ডা পরিক্রমা ২০১৪ নামে ই-বইটি প্রকাশ করছি। সঙ্গত কারণেই ছবি ব্লগগুলো দেওয়া গেল না যেহেতু ফাইলগুলো অনেক ভারী। ই-বইটিতে প্রকাশিত লেখাগুলো সাজানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়নি। কেবল বিষয় অনুযায়ী বিন্যাস করা হয়েছে। ফলে একটি বিষয়ের ওপর বিভিন্ন ধরনের লেখা পর পর পাওয়া যাবে। বইয়ের নামকরণ করেছেন ফজলুল ইসলাম এবং অন্যান্য সহায়তায় হামিম রহমান, কাজল আব্দুল্লাহ ও নাসিফ ফারুক আমিন। বানান সম্পর্কে একটি কথা। একেকজন ব্লগার একেক ধরনের বানান অনুসরণ করেছেন। কেউ বাংলা একাডেমির বানান মেনে লিখেছেন, কেউ অনুসরণ করেছেন প্রচলিত বানান। একান্তই ভুল না হলে আমরা বানান সংশোধন করতে যাইনি, ফলে পাঠকরা বইটিতে একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন বানান দেখতে পাবেন। পলিসি আড্ডা বানান বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট রীতি অনুসরণ করবে কিনা তা ভবিষ্যতে স্থির করা হবে। আশা করছি প্রকাশনাটি আপনাদের ভাল লাগবে, আপনারা ব্লগটির সঙ্গে জড়িত হতে আরো আগ্রহ বোধ করবেন। যদি এ বই আপনাদের কিছুমাত্র চিত্ত আকর্ষণ করে তবেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক বলে আমরা মনে করব। পলিসি আড্ডা পরিক্রমা ২০১৪ সম্পাদনা প্রিসিলা রাজ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ তৌফিকুর রহমান সার্বিক তত্ত্বাবধান এস এম মামুনুর রশিদ উপদেষ্টা আসিফ সালেহ শাগুফতা সুলতানা প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১৫ | ই-মেইল: infopolicy-addanet | ওয়েবসাইট: wwwpolicy-addanet | কপিরাইট: পলিসি আড্ডা শিক্ষা ১ বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষা: স্মরণীয় ও করণীয় ২ কৃষ্ণকিশোর চাকমা: পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ ৩ হাওরের ঝিল আর জাহিনূরের হাঁস ৪ সবার জন্য শিক্ষা: রাষ্ট্রীয় নীতির প্রাসঙ্গিকতা ৫ ‘সবার’ জন্য শিক্ষা কি নিশ্চিত করা যাচ্ছে? ৬ পাথরের খাঁচায় পড়ালেখা ৭ আরিফুল, একা ও অনেক ৮ সবার জন্য শিক্ষা: প্রসঙ্গ সামাজিক অস্পৃশ্যতা ৯ সিলেটে শিক্ষার হার এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ১০ পথকলি পাঠশালা ১১ আমার ইচ্ছার শক্তি ১২ ইসমাইলের আনন্দ ১৩ প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণে সহায়তা দিলেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১৪ শিক্ষার চালচিত্র ও আগামী প্রজন্ম ১৫ সবার জন্য শিক্ষা: আইন, নীতি ও পরিকল্পনা বিষয়ে কিছু প্রশ্ন ১৬ শিশুর সৃজনশীল বিকাশ ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ১৭ শচি রানীর পাঠশালা নিরাপদ যোগাযোগ ১৮ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণ দিবস ও কিছু প্রসঙ্গ ১৯ ভাঙাচোরা জনপরিবহন ও মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন ২০ পথচারীর জন্য দুই নিয়ম ২১ অসীম স্যারের মমতা ২২ শিশুর রাস্তা পারাপার ও গণপরিবহন ব্যবহার ২৩ সড়ক নিরাপত্তায় তরুণদের উদ্যোগ ২৪ রুস্তম মিয়ার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নারী ও শিশু ২৫ প্রযুক্তির অপব্যবহারে নারী নিপীড়ন: রুখে দাঁড়াতে হবে এখনই ২৬ নারীপুরুষ বৈষম্য ও লিঙ্গবিভাজিত ভাষা ২৭ নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ২৮ ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণে শান্তি ও নারী-পুরুষ সমতা ২৯ শিশু যৌন হয়রানি ৩০ শিশুবিয়ে বন্ধে প্রয়োজন কার্যকর সামাজিক আন্দোলন ৩১ কোমলের গল্প ও শিশুর নিরাপদ শৈশব ৩২ শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা ৩৩ মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের নারী কৃষি ৩৪ ধানচাষে এসআরআই পদ্ধতি প্রসারের গুরুত্ব পরিবেশ ৩৫ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত ৩৬ সুন্দরবনের ভেতর বাণিজ্যিক নৌচলাচল বন্ধ করতেই হবে ৩৭ প্রসঙ্গ: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা ২০০৯ ৩৮ বৈরী জলবায়ু: দরকার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ ৩৯ সার্ক সম্মেলন ও পরিবেশ বিষয়ক বহুপাক্ষিক সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ৪০ পুষ্টি কথন ৪১ মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশুখাদ্য বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ আইন: অনলাইন প্রচারণা ৪২ সাম্প্রতিক কালের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি অভিবাসন ৪৩ ফিফা বিশ্বকাপ ও কাফালা প্রসঙ্গ ৪৪ কাগজপত্র নাই, তো অধিকারও নাই—ব্যাপারটা কি এমন? ৪৫ গৃহশ্রমিক: বৈষম্য ও বঞ্চনার এক জীবন অন্যান্য ৪৬ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী: নিবিড় সমন্বয় ও তদারকি জরুরি ৪৭ সহস্রাব্দ উন্নয়ন পরবর্তী লক্ষ্য ও আমাদের পরিস্থিতি ৪৮ জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রসঙ্গে ৪৯ জন্মহারে ক্রম পরিবর্তন: কিছু ভবিষ্যৎ সমস্যার ইঙ্গিত ৫০ মোবাইল ব্যাংকিং: বাড়ছে ব্যবহার, বাড়ছে অপরাধ ৫১ জিহাদের লাশ, পিতার করুণ মুখ আর স্বরূপে বাহিনী ৫২ বাংলাদেশের পানি সমস্যা ৫৩ মমতার নতুন অবস্থান স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘নাগরিকত্বহীন’ ছিটমহলবাসীদের ৫৪ তালপাখায় ভর করে বেঁচে আছে বিপণ্ন শব্দকর সম্প্রদায় ৫৫ দুর্নীতি: দুই দল যখন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ১ বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষা: স্মরণীয় ও করণীয় প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ৮, ২০১৪ লেখক: আবদুস সালাম, সহযোগী অধ্যাপক, আইইআর ও একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে বিগত ৪৩ বছর আগে। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের প্রয়াসে বাংলাদেশের সংবিধান শিক্ষাকে রাষ্ট্রের একটি মৌলিক নীতি হিসেবে চিহ্নিত করে ১৭ (ক) (খ) ও (গ) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, “রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক- বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন”। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার সীমানা পেরিয়ে এই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংক্রান্ত নানা ঘোষণাপত্রে ‘সাক্ষর রাষ্ট্র’ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে ‘Education is a fundamental human right as set forth in UN Declaration Human Right, 1948′। এ ঘোষণাপত্রের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। কমপক্ষে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সাধারণভাবে সকলের জন্য লভ্য হবে এবং উচ্চ শিক্ষায় মেধানুযায়ী সকলের প্রবেশাধিকার থাকবে। পরবর্তীকালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত (২০ নভেম্বর, ১৯৮৯) শিশুদের অধিকার সংবলিত Convention on the Rights of the Child, 1989 -এর ২৮ নম্বর ধারায় শিশুদের শিক্ষা সম্পর্কে ঘোষণা করেছে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে এবং এ অধিকার শিক্ষার সমান সুযোগ সুবিধার ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে অর্জনের জন্য রাষ্ট্রসমূহ বিশেষভাবে, (ক) প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং তা বিনাবেতনে সকলের নাগালের মধ্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এতসব জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারনামা অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কাছে প্রণিধানযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র প্রদর্শন করে। এদেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাক্ষরতা কিংবা ন্যূনতম মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে যার প্রকৃত বাস্তবায়ন সুদূর স্বপ্নবিলাস বৈ কিছু নয়। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা নেতৃত্বের দুর্বলতা: যে কথাটি অকপটে বলতে আমার দ্বিধা নেই সেটা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৩ বছরে উন্নীত হওয়া সত্তে¡ও বিগত চার দশকে সাক্ষরতার হার মাত্র অর্ধেকের একটু বেশিতে পৌঁছতে পেরেছে। যদিও এই রাষ্ট্র কথিত সাক্ষরতার হার শুধু পরিমাণগত দিক থেকেই বিবেচনা করা যায়। কিন্তু সাক্ষরতার যদি গুণগত দিক বিবেচনা করা যায় তাহলে প্রকৃত সাক্ষরতার হার এক চতুর্থাংশে পরিণত হবে। এর অন্যতম প্রধান কারণ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ রাষ্ট্র আয়োজিত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে অপ্রকাশিত বহুবিধ কারণে। বিগত সময়গুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সহায়তায় বেসরকারী সংস্থাগুলোর যথাযথ নেতৃত্বের মাধ্যমে যতটুকু সাক্ষরতার হার বেড়েছে রাষ্ট্রের মূলধারায় অর্থাৎ সরকারী প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের শিক্ষামূলক নেতৃত্বে চরম দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে নিজের দেশের যোগ্য শিক্ষামূলক নেতৃত্বের বিবেচনার পরিবর্তে রাষ্ট্রযন্ত্রে অবস্থিত প্রথাগত রাজনৈতিক বিবেচনায় অসংখ্য অযোগ্য নেতৃত্বকে শিক্ষাক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রদান করে এবং এখনও করছে। যার সূদুরপ্রসারী ফল কখনও ভাল হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যকার অবস্থিত যোগ্য, যথার্থ একাডেমিক মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞ শিক্ষানেতৃত্বদের চিহ্নিত করে তাঁদেরকে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র কর্তৃক সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী চিহ্নিত না করা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে সঠিক তথ্য সেল গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সে কারণে দেশে ‘কত ধরনের কত সংখ্যায়’ সুবিধাবঞ্চিত মানুষ রয়েছে, সে ধরনের তথ্য রাষ্ট্রের কাছে না থাকায় আনুষ্ঠানিক কিংবা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড না নেওয়ার ফলে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারছে না। তাছাড়া সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সম্পর্কে প্রত্যয়গত ধারনা অস্বচ্ছ থাকায় এদের জন্য সঠিক ও যর্থাথ মাত্রায় শিক্ষা কর্মসূচী হাতে নিতে পারছে না।এক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মাত্রায় কিছু সফল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলেও রাষ্ট্র নিজে সেটা করতে সক্ষম হচ্ছে না । সে কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বিদ্যমান সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী চিহ্নিতকরণ জরুরী হয়ে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কতিপয় বাস্তবতা ও ধারণাকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। (ক) ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ: বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে একটি ছোট রাষ্ট্র হলেও এদেশে রয়েছে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। যার দরুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থানগত সুবিধাবঞ্চিত মানুষ রয়েছে। যেমন, প্রধান ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর অঞ্চল, হাওড় অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে বাঙালী ও আদিবাসী যাঁরা রাষ্ট্রের সমতলভূমি থেকে সার্বিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা প্রয়োজন। (খ) সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী : বাংলাদেশে সুষম সামাজিক মানসিকতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী বিকশিত না হওয়ার কারণে কিংবা রাষ্ট্র সমমাত্রায় সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিদ্যমান রয়েছে সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। যাদেরকে সমাজ উদারনৈতিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না বলে তাঁরা শিক্ষাসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন-পতিতালয়ে জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা শিশু, যাযাবর শ্রেণি যেমন বেদে গোষ্ঠীর জনগণ, যাদের নূন্যতম কোন তথ্য রাষ্ট্রের হাতে নেই। ফলে তাঁরা চির শিক্ষা বঞ্চিত মানুষের কাতারে সামিল রয়ে যাচ্ছে । (গ) অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্ট সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী: সাধারণ তথ্য মতে, বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। এছাড়াও বিশ্বায়নের তালে তাল মেলাতে গিয়ে বংশ পরম্পরায় এদেশে কৃষিভিত্তিক মানুষদের একটি বড় অংশ খণ্ড খণ্ড ভূমি থেকে অতি ক্ষুদ্র খণ্ড ভূমি কিংবা একসময় ভূমিহীন মানুষে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত ধনী পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিকভাবে ভূমিহীন হতদরিদ্র মানুষ সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রের হাতে এসব নবসৃষ্ট সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কোনো তথ্যভাণ্ডার আছে কিনা তা আমাদেরও জানা নেই। ফলে এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষ থেকে জন্ম নেয় পরবর্তী আরো অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। শিক্ষা পরিকল্পনায় এদেরকে কি কখনও রাষ্ট্র বিবেচনায় রাখে? যদিও রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে এদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। (ঘ) ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী: পাহাড়ী অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগণ রাষ্ট্রের নীতিগত কারণে অথবা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বহু নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন দূর পাহাড়ী দুর্গম পথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করার চেয়ে তাঁদের অনেকের কাছেই প্রকৃতির বুক চিরে দৈনন্দিন খাবার সংগ্রহ করা বেশী গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্রকে এদের সঠিক সংখ্যা চিহ্নিত করে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক আবাসিক শিক্ষার সুযোগ তৈরী করা বাঞ্ছনীয়। (ঙ) শহরের বস্তিবাসী মানুষ: দেশের নানা অঞ্চল থেকে নানা কারণে আগন্তুক শহরায়নের প্রবণতায় ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠছে সুবিধাবঞ্চিত বস্তিবাসী মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বস্তিতে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের তথ্য রাষ্ট্রের হাতে থাকা অত্যাবশ্যক। সেই তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা সাংবিধানিক দায়িত্ব। বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী ছাড়া রাষ্ট্র এদের জন্য এযাবতকালে কতটা সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে তা প্রশ্নের সম্মুখীন। (চ) শহরে রাস্তায় ভাসমান জনগোষ্ঠী: নগরায়নের ছায়াতলে দেশের নানা অঞ্চল থেকে আগত অগণিত মানুষ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরতলীর রাস্তায় দিন যাপন করে। এরা সারাদিন জীবনের মৌলিক চাহিদা একমুঠো খাবারের’ জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করলেও রাতে রাস্তায় ঘুমায়। এদের মধ্যে আবালবৃদ্ধবণিতা সব শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। কিন্তু সরকার বাহাদুর কি তাদের কোনো পরিসংখ্যান রাখেন? সে কারণে এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের তথ্যভাণ্ডার যেমন রাখা জরুরী তেমনি তাদের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আয়োজন করাটাও জরুরী। এক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলো সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। (ছ) অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষ: এছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যাদের মধ্যে দরিদ্র এতিম শিশু, ছিট মহলে বসবাসরত দরিদ্র মানুষ, শারীরিক ও মানসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, হতদরিদ্র শিশু বিশেষ করে নারী শিশু ইত্যাদি। এদের সকলকে শিক্ষার আওতায় রাষ্ট্র যদি আনতে না পারে তবে ২০১৫ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন বাংলাদেশের জন্য অসম্ভবই রয়ে যাবে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের অংশগ্রহণকারী শিক্ষানুরাগী সকলকে এক কাতারে এনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। তাদেরকে শিক্ষার আওতায় আনাও রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। আমরা হয়তো উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার নীতি নির্ধারণে ও শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন কৌশল নির্বাচনে সুচিন্তিত বাস্তবধর্মী প্রজ্ঞাবান নির্দেশনা প্রণয়নে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারি। কিন্তু দেশব্যাপী তা বাস্তবায়নের কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে নতুবা কালের ঘূর্ণিপাকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনার আড়ালেই রয়ে যাবে। ২ কৃষ্ণকিশোর চাকমা: পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ২, ২০১৪ লেখক: পুলক চাকমা, সহকারী পরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কৃষ্ণকিশোর চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষার অগ্রদূত হিসাবে পাহাড়ের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। গত শতকের শুরুর দিকে পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা অপ্রতুল ছিল তা সহজেই অনুমেয়।। এ অবস্থাতে সরকারের শিক্ষা দপ্তরের স্কুল পরিদর্শক কৃষ্ণকিশোর তাঁর সরকারি দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত ছিলেন না বরং পাহাড়িদের মধ্যে বিদ্যার উৎসাহ জাগানো এবং স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় বিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং আমৃত্যু সেকাজেই ব্যাপৃত ছিলেন।কৃষ্ণকিশোর চাকমা, ছবি: জেলা প্রশাসন, রাঙ্গামাটি, ২০০৪ কৃষ্ণকিশোরের জন্ম রাঙ্গামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার কেরেতকাবা মোনতলা গ্রামে ১৮৯৫ সালে ১৪ই জুলাই। সুন্দরবি চাকমা ও চানমুনি চাকমার তিন ছেলের মধ্যে কৃষ্ণকিশোর সবার বড়। বাকি দুই ভাই হরকিশোর চাকমা ও চিত্তকিশোর চাকমা। প্রথমদিকে তাঁদের পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে মাওরুম ছড়ার উৎপত্তি যেখানে সেই সত্তা-ধুরুং নামের এলাকায় ছিল, পরে তাঁরা মহাপ্রুম এলাকায় সরে আসেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে বাস করলেও সুন্দরবি ও চানমুনি চাকমার পরিবারটি শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন ছিল। ফলে তাঁদের তিন ছেলেই উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বড় ছেলে কৃষ্ণকিশোর ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করার পর ১৯২০ সালে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিভাগে সাবইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন। মেজ ভাই হরকিশোর চাকমাও ছিলেন শিক্ষক। সমাজসেবক হিসাবে খ্যাত ছোট ভাই চিত্তকিশোর চাকমাও শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। ষাটের দশকে তিনি ছোট মহাপ্রুম মাধ্যমিক স্কুলসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তার ভূমিকায় ছিলেন। চিত্তকিশোরের পুত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) ষাটের দশকে সূচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অপর তিন সন্তান, জ্যোতিপ্রভা লারমা, শুভেন্দু প্রভাস লারমা ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সন্তু লারমা নামে যাঁর অধিক পরিচিতি, সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগুলোর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন বা এখনও আছেন। কৃষ্ণকিশোরের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শিক্ষানুরাগ আর অধিকার সচেতনতা – এ দু’য়ের মিশেলে পরিবারের যে আদর্শিক চেতনা তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি কখনও। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাশাসিত সমাজে উচ্চবর্গীয় গোষ্ঠীর প্রতাপে সাধারণ মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেতেন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা কেবল উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সুন্দরবি চাকমা ও চানমুনি চাকমা এসব বাধা অতিক্রম করে সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁদের সন্তানরা বিশেষ করে কৃষ্ণকিশোর সমাজের গোষ্ঠীপতিদের সামন্তীয় চিন্তাচেতনার সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি এবং সামাজিক সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কঠোর পরিশ্রম, দূরদর্শিতা ও দৃঢ় সংকল্পের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, শিশুদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা, স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য-অনুদান আদায়ের ব্যবস্থা, বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য কৃষ্ণকিশোর আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। শিক্ষা বিভাগের সাবইন্সপেক্টর থাকা অবস্থায় তিনি কখনও সাইকেলে, কখনও পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শনে যেতেন এবং অভিভাবক ও গ্রামের মুরুব্বীদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম সকল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। মূলতঃ তাঁরই ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ১৯২২ সালে মগবান ইউপি স্কুল ও সুবলং খাগড়াছড়ি ইউপি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯২৩ সালে মহাপ্রুম এমই স্কুল, রামগড় এমই স্কুল, পানছড়ি এমই স্কুল, দিঘীনালা এমই স্কুল এবং তুলাবান এমই স্কুল এই বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কৃষ্ণকিশোর এবং তাঁর সমসাময়িকরা পাহাড়ে যে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর পরের প্রজন্ম। আর সে কারণেই আজ চাকমা জাতির মধ্যে শিক্ষার হার বেশ উঁচু। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী চাকমাদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭০ শতাংশের বেশি। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, কৃষ্ণকিশোর চাকমার নেতৃত্বে শুরু হওয়া শিক্ষা আন্দোলন দ্বারা প্রাথমিকভাবে লাভবান হয়েছে চাকমারা। এর কারণ এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল রাঙামাটিকে ঘিরে যেখানে কৃষ্ণকিশোর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে প্রথম দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। রাঙামাটির কর্ণফুলি নদীর উপত্যকায় সেসময় পাহাড়িদের মধ্যে মূলতঃ চাকমাদের বসতিই ছিল। পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলনের এ চেতনা তিনি খাগড়াছড়িতেও পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেখানে চাকমা ছাড়াও, মারমা ও ত্রিপুরাদের বাস যারা এ আন্দোলনের সুফল কিছুটা হলেও পেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো যে আটটি জাতি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খুমি, পাংখোয়া, খ্যাং, লুসাই, মুরুং ও চাক, আরো দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করার কারণে শিক্ষা আন্দোলনের ঢেউ তাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লেগেছে। তাছাড়া এর পেছনে ভাষাগত বাধাসহ বিবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক কারণও কাজ করেছে। কৃষ্ণকিশোর ও তাঁর ভাইদের সামন্ত সমাজের প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে শিক্ষালাভ করতে হয়েছিল। সামন্তীয় মূল্যবোধ এবং পশ্চাদপদ চিন্তা-চেতনা জাতিকে কতটা পিছিয়ে রাখে তা তিনি ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তাই সমাজ থেকে ক্ষতিকর সামন্ত মূল্যবোধ ও শ্রেণী বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেও তিনি জনচেতনা প্রসারে কাজ করে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখার জন্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ২০০১ সালে কৃষ্ণকিশোর চাকমাকে মরণোত্তর বিশেষ সন্মাননা প্রদান করেছে। পাহাড়ে শিক্ষার পথিকৃৎ এ মহান মানুষটি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ৩ হাওরের ঝিল আর জাহিনূরের হাঁস প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৩০, ২০১৪ লেখক: প্রিসিলা রাজ মোটর সাইকেলের পিছে সওয়ার হয়ে শুকনো হাওরের মাটির পথ ধরে চলেছি। সূর্য মাথার ওপর থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মেঘের ছায়াও পাওয়া যাচ্ছে। গরমে গলছি ঠিকই কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ করছি বৃষ্টি যাতে না আসে কারণ ব্যাগে ক্যামেরা। যত দূর চোখ যায় হাওরের বিরান নিচু ভূমি। মাঝে মাঝে উঁচু ভিটার ওপর সারি সারি বাড়ি, ওগুলো হাওরের গ্রাম। বছরের ছয়-আট মাস যখন থৈ থৈ পানি তখন বাড়িগুলোর নিশানাই জেগে থাকে। এবড়ো-খেবড়ো পথে মোটরবাইকের ঝাঁকি খেতে খেতে পিঠ আর কোমরের বারোটা বেড়ে যাচ্ছে। পথটা একটা জলাশয়ের ধারে এসে পড়ল। বেশ বড় ঝিল, তাতে কয়েকজন লোক বাঁশের বোঝা নিয়ে কী যেন করছে। দূরে সবুজ ধানের ক্ষেতে অনেকগুলো সাদা বক নানা ভঙ্গিতে উড়ছে, বসছে। স্বাধীন, নিঃশঙ্ক প্রাণ। মোহনীয় দৃশ্য। আমার চালক স্থানীয় যুবক, নাম মোহসিন। গাড়ি থামাতে বললে বিনা বাক্যব্যয়ে থামাল। ছেলেটা স্বল্পবাক। আমি পিঠের হ্যাভারস্যাক ওর জিম্মায় রেখে ক্যামেরার ব্যাগটা নিয়ে বকসারির উদ্দেশে হাঁটা দেই। নরম মাটি, তাতে চিকন সবুজ ঘাসের ছোট ছোট ঝোপ, তার মধ্যিখানে সবুজ গুটি গুটি ফুল। বুঝি বা হাওরের নিজস্ব ঘাস। তাতে বেশ খানিকটা দূরে থামি যাতে ওরা ভয় পেয়ে উড়াল না দেয়। তারপরও কী করে যেন আমার অস্তিত্ব বা উদ্দেশ্য টের পেয়ে ওরা উড়ে যায়, এরই মধ্যে কয়েকটা ছবি তুলতে পারি। মোহসিন পাড় থেকে ডাক দেয়, চলে আসতে বলে। কিছুটা বিরক্ত হই, ওকে ভাড়া করেছি, টাকা যা লাগে দেব। ও হয়ত ভাবছে আমি বাড়তি খাটিয়ে টাকা দেব না। যাই হোক, কাজ হয়ে গেছিল, ফেরার পথ ধরি। আবার আটকে যাই। বেশ খানিকটা দূরে এক পাল হাঁস ঝিলে চরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে তাদের কালচে খয়েরি নড়াচড়া মুগ্ধ হয়ে দেখি। ঝিলের ধারে গোলাপি গেঞ্জি গায়ে একটা ছোট ছেলে, হাতে লাঠি আর কাঁদের পেছন থেকে ডান্টিসহ ছাতা ঝুলছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে যাই। কাছে যেতে বুঝি এগুলো আসলে হাঁসের ছানা, সবে বড় হচ্ছে। ছেলেটা তলচোখে আমার ছবি তোলা দেখে। জিজ্ঞেস করি হাঁসগুলো ওর কিনা। মাথা নাড়ে - ওর না। কার তবে? ভাইয়ের। কয়টা হাঁস এখানে? একটু হিসাব করে বলে সাড়ে নয়শ’। আগে ছিল এগারশ’। বাকিগুলো মরেছে। ‘তোমার একটাও হাঁস নাই?’ এবার বলে আছে। শ’খানেক হবে। আগে আরো বেশি ছিল, মরে গিয়ে কমে গেছে। ছেলেটার মুখ প্রসন্ন না। ক্লান্তি নাকি আমাকে পছন্দ হচ্ছে না? ‘নাম কীরে তোর?’ অস্পষ্ট স্বরে বলে, ‘জাহিনূর’। ‘পড়াশোনা করিস?’ মাথা ওপর-নিচ হয়। কোন ক্লাসে? ‘কেলাস থিরি।’ ‘হাঁস নিয়ে বেড়াইস, ইস্কুল যাইস কখন?’ ‘এক দিন যাই, দুই দিন যাই না।’ এতক্ষণে দাঁত বের হয় জাহিনুরের। তবে ওর হিসাব বড় পাকা, ওর হাঁস কয়টা আর ভাইয়ের কয়টা পাকা দোকানির মতো আঙুল গুণে বলে দিলো। ইস্কুলে তার এমনই যাওয়া হয় যে বিদ্যালয়ের নামই বলতে পারল না বেচারা। বলে ভাইয়ের হাঁস দেখতে হয় তাই নিয়মিত যাওয়া হয় না। তবে এমন হওয়াও বিচিত্র না ইস্কুল পালায় বলেই তাকে হাঁসের রাখালিতে লাগানো হয়েছে। হাঁসের পালের সঙ্গে ওর একটা ছবি তুলতে চাইলাম। কিন্তু ও তাদের কাছে যেতে চাইল না। ওদের খাবার দেওয়া হয়েছে, ভয় পেয়ে পালাতে পারে। ঝিলপারে দাঁড়ানো জাহিনূরের ছবি তুলে অতএব মোটরসাইকেলের দিকে রওনা দেই। আলোকচিত্র: লেখক ৪ সবার জন্য শিক্ষা: রাষ্ট্রীয় নীতির প্রাসঙ্গিকতা প্রকাশিত হয়েছে: আগষ্ট ১০, ২০১৪ লেখক: উৎপল কান্তি খীসা, গবেষক আমরা জানি বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশের অধিক বাঙালি। অবশিষ্ট জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে ৪৫টির বেশি ক্ষুদ্র জাতির মানুষ। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, মণিপুরী, রাখাইন, হাজং, কোচ, মুন্ডা ক্ষুদ্র জাতিগুলোর অন্যতম। এসব জাতির মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছেন। অতীতে এসব জাতি নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে যথেষ্ট বলীয়ান ও সমৃদ্ধ ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে তারা আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। ভাষা, শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিসহ অন্যান্য মানবিক, নাগরিক অধিকার, শক্তি ও সম্পদ সবকিছুতেই তারা আজ ভীষণভাবে পিছিয়ে। ভুলে গেলে চলবে না যে, নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ বহু জাতিসত্তার আবাসস্থল। নানা জাতির মানুষ তাদের ভাষা, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে এদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করেছে। বিভিন্ন জাতির রীতিনীতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের পথে প্রতিনিয়ত রসদ যুগিয়েছে এবং যুগিয়ে যাচ্ছে। এদেশ গঠনে সবার ভূমিকা আছে। আজ স্বাধীনতার চার দশকের অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে যা একটি দেশের উন্নতির জন্য কম সময় না। এর চেয়েও অনেক কম সময়ে অনেক রাষ্ট্র বিশ্বে সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছে। সেসব দেশের সরকার নানা জাতির জনগণের ভাষা, শিক্ষা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি প্রভৃতি সুরক্ষা এবং বিকাশে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিমধ্যে সাফল্য অর্জনের অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বাংলা ভাষার জন্যে এ জাতি প্রাণ দিয়েছে। পৃথিবীতে খুব বেশি জাতির এ নজির নেই। মাতৃভাষা রক্ষায় বাঙালি যে ইতিহাস রচনা করেছে তার স্বীকৃতি বিশ্ব দিয়েছে। জাতিসংঘ এর স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক বড় একটি অর্জন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তারা, বা সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রতিবেশী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষা বা বিকাশে কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ নিতে সদা দ্বিধাগ্রস্ত। এক্ষেত্রে তারা প্রায় সবসময় পশ্চাদমুখী নীতি অনুসরণ করে এসেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী একাত্তর-পূর্ব কালে যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণের লক্ষ্যে যে হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শ্রেণীটি অনেকটা যেন সেভাবেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিগুলাকে তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে নানারকম তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। ফলে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রকাঠামোর কোনো ক্ষেত্রেই দেশের নাগরিক সব জাতির মানুষের সুষম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অধিকার স্বীকার আর অর্জনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর বিরাট তফাৎ রয়েই গেছে। এ বৈষম্য ও উপেক্ষার প্রতিফলন আমরা দেখি রাষ্ট্রের প্রায় সব ভিত্তিমূলক দলিলে, শিক্ষানীতিসহ জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন নীতিমালা বা পরিকল্পনাগুলো থেকে শুরু করে দেশের সংবিধানে পর্যন্ত। এ নিবন্ধে সরকারের সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সুরক্ষা প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা উপস্থিত করা হবে। সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষা দর্শন এ সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যে আমাদের সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতি খতিয়ে দেখা দরকার। সংবিধানের ৩, ১৫ ও ১৭ নং ধারায় বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা দর্শনের মূল বীজ বা চেতনা নিহিত। শিক্ষাকে সংবিধানে নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ধারা-৩ অনুসারে দেশের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। যদিও বাংলা ছাড়া এদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ আরো অনেক ভাষা রয়েছে। একটি রাষ্ট্রে জনগণের যত ভাষা থাকবে প্রত্যেকটি কি রাষ্ট্র ভাষা নয়? দাপ্তরিক ভাষা এক বা একাধিক হতে পারে। পক্ষান্তরে একটি রাষ্ট্রে যত ভাষা থাকবে প্রত্যেকটিই তো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের ভাষা। অন্যদিকে নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা সম্পর্কে সংবিধানের ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা যায়। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা বিষয়ে ১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র – (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে